পৃথিবীর সকল দেশেই এখন নারী-পুরুষ সমতা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। অনেকেই বলেন থাকেন যে, ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা দেয়নি বরং শুদুই পুরুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে। নারীদেরকে সমতা দেয়নি। একদল মানুষ নারীর পক্ষ নিয়ে ‘নারীবাদী’ হয়ে গেছেন। তাদের দেখাদেখি মুসলিম সমাজেও এ ধরনের চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছে। যার ছায়া এসে পৌঁছেছে আমাদের বাংলাদেশেও। অনেকের মনেই প্রশ্ন ইসলামে নারীরা পর্দায় কেন? সম্পত্তিতে ভাইয়ের অর্ধেক কেন? দুই নারীর সাক্ষী এক পুরুষের সমান কেন । এ বিষয়ে সঠিক বুঝ লাভ করতে হলে, চোখ থেকে পশ্চিমা অপপ্রচারের রঙিন চশমা খুলতে হবে। বুঝতে হবে যে, পাশ্চাত্যের নারী-পুরুষ সমতার ধারণা ভুল। আমদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে এক লোক প্রশ্ন করল, হে প্রিয় নবী আমি কার সেবা করব, নবীজী উত্তরে বললেন, ‘তোমার মায়ের’। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করল, এরপর কার? হযরত জবাব দিলেন, ‘তোমার মায়ের’। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, হে রাসূল এরপর কার? প্রিয় নবী আবারো জবাব দিলেন, ‘তোমার মায়ের’। লোকটি ফের প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল এরপর কার? তখন চতুর্থবারের মতো জবাব দিতে গিয়ে নবী করিম সা. বললেন, তোমার বাবার’ (আল হাদিস)। এ প্রশ্নোত্তরে নারীর মর্যাদা যে পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি তা কি স্পষ্ট নয়? এরপর ধরা যাক, তার মানে নারী/মা এখানে পাচ্ছে সিলভার এবং গোল্ড মেডেল আর পুরুষ বা বাবাকে একটি শান্তনা পুরুষ্কার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। তার পরেও আমরা বলবও ইসলামে নারীর অধিকার নেই??? নারীর জীবন জীবিকার কথা। পৃথিবীর সব নারী ও তাদের শিশুরা পুরুষদের কাঁধেই আমানত হয়ে আছে। এটি আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান। শরিয়তও প্রকৃতি অনুযায়ীই তৈরি। এরপরও নারীর মালিকানা ও নিজ অঙ্গনে কর্তৃত্ব ইসলামে স্বীকৃত। তবে, নারীর মাতৃত্ব, নারীত্ব, সতিত্ব, ঈমান ও সম্মান রক্ষার্থে তাদের সেফটির ওপর জোর দিয়েছে। পুরুষের চালচলন, জীবিকার কঠোর বোঝা, কঠিন দৈহিক শ্রম, অনিরাপদ চলাচল থেকে নারীকে দূরে রেখেছে। এটি তার প্রতি অবহেলা নয় বরং তার বিকল্পহীন দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্যই করেছে। কেননা, মানব শিশুর জন্ম, ধারণ-লালন, সংসারের পরিচালনা, পুরুষের শান্তিময় আশ্রয় সবই নারীর কাজ। এ হিসাবে নারীকে সুখি, নিরাপদ, নির্ঝঞ্ঝাট, পবিত্র ও সুরক্ষিত রাখা ইসলামের অভিপ্রায়। কেবল ইসলামি উম্মাহর ইমারত (খেলাফতের প্রধান) ও মুসলিম জামাতের ইমামত (পুরুষের জামাতের ইমামতি) ছাড়া নারী অন্য সবকিছুতেই ভূমিকা রাখতে পারে। এটি নারীর প্রতি অবজ্ঞা নয়, বরং মাতৃত্বের বৈশিষ্ট্যের প্রতি পরম শ্রদ্ধা। তবে, অধিক স্নেহ, নম্রতা ও কোমলতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভীরুতা, অমনোযোগিতা, পরিবেশ জ্ঞানের স্বল্পতা দরুণ বোধের সীমাবদ্ধতার জন্য (অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া) সাধারণত নারীরা সবসময় সবক্ষেত্রে স্বাভাবিক মন-মানসিকতা ধরে রাখতে পারে না। তাই, গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে তাদের সাক্ষ্য দু’জন মিলে একজনের সমান করা হয়েছে। তবে, এটিও আইনগত ক্ষেত্র ছাড়া জীবনের সব ক্ষেত্রে নয়। এটি উচ্চতর প্রজ্ঞাময় মহান সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্ত। প্রকৃতির ওপর মানুষের যেমন হাত নেই, অভিযোগ নেই, ঠিক তেমনই শরিয়তের ওপরও মানুষের হাত নেই, অভিযোগ নেই, থাকতে পারে না। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, নারীকে সম্মান দেওয়ার জন্যই ইসলাম তাদেরকে পর্দাশীল এবং জনসম্মুখে আসতে বারুন করেছে। এবার আসা যাক পুরুষের অধিকার বিষয়। সমাজে নারীর অবস্থান ও অধিকার নিয়ে আমরা বিভিন্ন কথা শুনে থাকি। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বর্তমানে যে কথাগুলো বলা হয়, তার মধ্যে বেশ কিছুই গ্রহণযোগ্য। আবার কিছু কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ আছে। নারী-পুরুষ সবারই অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া অপরিহার্য। কারণ, সমাজ দিনে দিনে সামনে এগোচ্ছে। শুধু নারী বা পুরুষেরই নয়, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।গত ৫০ বছরে সমাজ অনেকটা এগিয়েছে। এ সময়ে পুরুষের সাথে নারীরাও সমানতালে না হলেও এগিয়ে এসেছে। বেগম রোকেয়ার সময়ে যে সমাজ ছিল, সে সমাজকে আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। তিনি দেখেছিলেন, সে সময়ে মেয়েরা লেখাপড়া করার কোনো সুযোগই পেত না। তখন বেগম রোকেয়া নারীশিক্ষার ব্যাপারে সাহসী উদ্যোগ না নিলে আজ এ উপমহাদেশের নারীরা কেউই পড়ালেখা শিখতে পারত না। সমগ্র পৃথিবীতে, বিশেষ করে আমাদের দেশে মানুষের ওপর, বিশেষ করে নারীর ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চলছে, তার একটা ফাউন্ডেশন আছে, ভিত্তি আছে। অত্যাচার আকাশ থেকে আসছে না। নারীর ওপর পুরুষের এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরও যে অত্যাচার, তার আইডিওলজিক্যাল ফাউন্ডেশন হলো- সাধারণভাবে মানুষ বিশ্বাস করে, বিশেষ করে পুরুষরা বিশ্বাস করে, নারী পুরুষের চেয়ে ছোট, তাদের কোয়ালিটি খারাপ এবং তারা নীচু। এই বিশ্বাস অবশ্য নারীর মধ্যেও কিছুটা বিদ্যমান। মানুষের মধ্যে বিদ্যমান কতগুলো বিভ্রান্তি থেকে এ বিশ্বাসের জন্ম। আর এই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে নারীদের প্রতি অবহেলা, বঞ্চনা ও নির্যাতন। আমাদের দেশ থেকে যদি নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হয়, তবে ইসলামকে বাদ দিয়ে তা করা যাবে না। আমি এটা খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ইসলামকে বাদ দিয়ে আমাদের মতো ৯০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে চলা সম্ভব হবে না। যারা ইসলাম থেকে বিদ্রোহ করেছে তারা কিন্তু টিকতে পারেনি, পারছে না। যারা বিদ্রোহ করেছিলেন, তাদের পরিণতি ভালো হয়নি, খারাপ হয়েছে। বিনীতভাবে বলতে চাই, ইসলামের কাঠামোর মধ্যে আমরা যদি এগোতে পারি, তবে তা সবচেয়ে ভালো হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ইসলামের এ রকম একটি ফ্রেমওয়ার্ক আছে, যা নারীদের সামনে এগিয়ে দিতে পারে।আমি ইসলামের কোনো সাময়িক ব্যাখ্যা দেয়ার পক্ষে নই। সত্যিকার অর্থেই ইসলাম নারীকে ক্ষমতা দিয়েছে এবং সম্মানিত করেছে। নারীকে অধিকার দিয়েছে। সেগুলো ব্যাখ্যা করার আগে ‘আইডিওলজিক্যাল ফাউন্ডেশনের নতুন ভিত্তি যেটা হতে পারে সে প্রসঙ্গে বলতে চাই। কী সেই ভিত্তি যে ভিত্তির ওপর নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্য বিদ্যমান? আল্লাহ মানুষের চেহারা একরকম করেননি। সব দিক থেকে যেকোনো দু’জন মানুষ সমান নয়। ওজন, উচ্চতা, বর্ণ, শিক্ষা ইত্যাদি সব কিছুতে একজন মানুষ থেকে আরেকজন আলাদা। কিন্তু মৌলিকভাবে প্রত্যেক মানুষই সমান; আল্লাহর কাছে সমান। এর পাঁচটি প্রমাণ নিম্নে তুলে ধরছি- প্রথমত, আল্লাহ তায়ালা এ কথা খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, মূল মানুষ হচ্ছে ‘রূহ’ যাকে আমরা আত্মা বলি। মূল মানুষ কিন্তু শরীর নয়। দেহ তো কবরে পচে যাবে। আমরা যারা ইসলামে বিশ্বাস করি, তারা জানি- মূল মানুষ হলো ‘রূহ’। আল্লাহ সব মানুষকে, তার রূহকে একত্রে সৃষ্টি করেন, একই রকম করে সৃষ্টি করেন এবং একটিই প্রশ্ন করেন। আল্লাহর প্রশ্নের উত্তরও নারী-পুরুষ সবাই একই দিয়েছিল। আল কুরআনের সূরা আরাফের একটি আয়াত হলো- “স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরকে বের করেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলে, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি আমাদের প্রতিপালক। আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি’। এটা এ জন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বলো, আমরা তো এ বিষয়ে জানতাম না।” (সূরা আল আরাফ-৭:১৭২) তার মানে আল্লাহর সাথে একটি পয়েন্ট সব নারী ও পুরুষের একটি চুক্তি হলো- ‘আপনি আমাদের প্রভু, আমরা আপনাকে মেনে চলব। এ ক্ষেত্রে পুরুষের চুক্তি আলাদা হয়নি। নারীর চুক্তি আলাদা হয়নি। সুতরাং আমরা দেখলাম, আমাদের আইডিওলজিক্যাল ফাউন্ডেশনের প্রথম কথা হচ্ছেÑ মূল মানুষ হচ্ছে ‘রূহ’ এবং তা সবার সমান। এই সাম্যের পরে যদি কোনো অসাম্য থাকে তাহলে তা অত্যন্ত নগণ্য। তার মানে হচ্ছে, মানুষের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এক এবং সে মানুষ হিসেবে একই। এটি হলো নারী-পুরুষের সাম্যের প্রথম ভিত্তি। দ্বিতীয়ত, আমরা পুরুষরা গর্ব করি, আমাদের শারীরিক গঠন বোধ হয় নারীর তুলনায় উত্তম। আল্লাহ বোধ হয় আমাদের তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ করে বানিয়েছেন এবং মেয়েরা আনকোয়ালিফাইড বা অযোগ্য। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা একটি কথা কুরআনে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, সব মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে, কিন্তু প্রত্যেক মানুষ ‘ফার্স্ট ক্লাস’। যারা নামাজ পড়েন তারা এই আয়াত জানেন, সূরা ত্বীনে আল্লাহ বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সর্বোত্তম কাঠামোয়।’ (সূরা আত ত্বীন- ৯৫:৪) তিনি এখানে ‘পুরুষকে বলেননি। তার মানে আমাদের গঠনে পার্থক্য আছে, আমরা এক নই, আমরা ভিন্ন কাঠামোর। কিন্তু সবাই ফার্স্ট ক্লাস বা সর্বোত্তম। সুতরাং নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, নতুন নারী আন্দোলনের জন্য অথবা নতুন মানব আন্দোলনের জন্য এটা দ্বিতীয় ভিত্তি। মৌলিক এ কারণে বলছি, নারী-পুরুষের মধ্যে ছোটখাটো পার্থক্য বিদ্যমান। পুরুষরা এ কথা বলা ঠিক হবে না যে, মেয়েদের স্ট্রাকচার খারাপ। আল্লাহ তাতে অসন্তুষ্ট হবেন। যারা মোমেন, যারা বিশ্বাসী, তারা এ কথা বলবেন না। সুতরাং নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্যের এটা হলো দ্বিতীয় প্রমাণ। তৃতীয়ত, আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, সব মানুষ একই পরিবারের; আদম ও হাওয়ার পরিবারের। সূরা নিসার প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলেছেনÑ ‘হে মানবজাতি, সেই রবকে তুমি মানো, যিনি তোমাদের একটি মূল সত্তা (নফস) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সত্তা থেকে তারা সঙ্গীকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ দু’জন থেকে তিনি অসংখ্য নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আন নিসা-৪:১) তার মানে আমরা এক পরিবারের। আমরা হচ্ছি বনি আদম বা আদমের সন্তান। আল্লাহ কুরআন শরিফে অন্তত ২০-৩০ বার বলেছেন, ‘ইয়া বনি আদামা’ (হে আদমের সন্তানরা)। বাবা-মা এবং সন্তান মিলে যেমন পরিবার তৈরি হয়, তেমনি ইসলামের দৃষ্টিতে মানবজাতি একটি পরিবার। সব পরিবারের ওপরে হলো মানবজাতির পরিবার। তার মানে, আমাদের মৌলিক যে সম্মান ও মর্যাদা তা সমান। ছোটখাটো কারণে আমাদের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। তবে জাগতিক মর্যাদা আসল মর্যাদা নয়। আইনের ভাষায় যেমন বলা হয়Ñ আইনের চোখে সব মানুষ সমান, তেমনি আল্লাহর কাছেও সবাই সমান। আল্লাহর কাছে সম্মানের একমাত্র ভিত্তি হলো তাকওয়া। আল্লাহ বলেননি, তার কাছে পুরুষ সম্মানিত বা নারী সম্মানিত। আল্লাহ বলেছেন- ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সূরা হুজরাত- ৪৯:১৩) আল্লাহর কাছেই যদি মর্যাদার এই ভিত্তি হয়, তাহলে মানুষের পার্থক্যে কি কিছু যায়-আসে? আল্লাহ বলেছেন, তিনি তাকওয়া ছাড়া (আল্লাহকে মানে আর কে মানে না) কোনো পার্থক্য করেন না। অতএব, আমরা এক পরিবারের সন্তান, আমাদের মৌলিক মর্যাদা সমান। কুরআনের সূরা নিসার একটি আয়াতের শেষ অংশে আল্লাহ বলেছেন- ‘এবং ভয় পাও সেই আল্লাহকে, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে অধিকার দাবি করে থাকো এবং ভয় পাও গর্ভকে বা মাকে।’ (সূরা আন নিসা-৪:১) আল্লাহ বলেছেন, গর্ভকে ভয় পাও। কুরআন শরিফের এই আয়াতটির তাফসিরে মিসরের বিখ্যাত আলেম সাইয়েদ কুতুব লিখেছেন, ‘এই ভাষা পৃথিবীর কোনো সাহিত্যে কুরআনের আগে লেখা হয়নি। আল্লাহ গর্ভকে ভয় করতে বলে মাকে সম্মান করার কথা বলেছেন, নারী জাতিকে সম্মান করার কথা বলেছেন’ (সূরা নিসার তাফসির, সাইয়েদ কুতুব)। সুতরাং আমাদের মৌলিক, সামাজিক মর্যাদা এ ক্ষেত্রেও সমান বলে প্রতীয়মান হলো। এটা আমাদের নতুন আইডিওলজিক্যাল ফাউন্ডেশনের তৃতীয় প্রমাণ। চতুর্থত, আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির সময় বলে দিলেন, ‘তোমরা সবাই খলিফা। তিনি বলেন, ‘ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদি খলিফা।’ আল্লাহ বলেননি, পৃথিবীতে তিনি নারী পাঠাচ্ছেন বা পুরুষ পাঠাচ্ছেন। পাঠালেন মানুষ, বললেন খলিফা। মানুষকে তিনি খলিফা নামে অভিহিত করলেন। খলিফা মানে প্রতিনিধি। আমরা পুরো মানবজাতি হচ্ছি আল্লাহর প্রতিনিধি। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে আমরা প্রত্যেকে তার প্রতিনিধি, আল্লাহর প্রতিনিধি। তবে এ কথা ঠিক, যদি আমরা গুনাহ করি, অন্যায় করি, খুন করি, অত্যাচার করি, জুলুম করি, ইমান হারিয়ে ফেলি- তাহলে আমাদের খলিফার মর্যাদা থাকে না। কিন্তু মূলত আমরা আল্লাহ পাকের খলিফা। (দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা-২:৩০; সূরা ফাতির-৩৫:৩৯) এই খলিফার মর্যাদার মধ্যেই রয়েছে সব ক্ষমতায়ন, যে ক্ষমতায়নের কথা আমরা বলে থাকি। ক্ষমতা ছাড়া কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে না। খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে গেলে প্রত্যেক নারী ও পুরুষের কিছু ক্ষমতা থাকতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি এই খেলাফতের মধ্যে রয়েছে। শুধু নারী নয়, খেলাফত শব্দের মধ্যে নারী-পুরুষ, দুর্বল সবার ক্ষমতায়নের ভিত্তি রয়েছে। সুতরাং নারী-পুরুষ মৌলিক সাম্যের এটি হলো চতুর্থ প্রমাণ। ইসলাম চায় প্রত্যেককে ক্ষমতা দিতে। কিন্তু এ মুহূর্তে যদি নারীরা বঞ্চিত থেকে যায়, তবে তাদের ক্ষমতায়িত করতে হবে। পুরুষরা কোনো দিন বঞ্চিত হলে তাদের ক্ষমতায়িত করতে হবে। তবে যে বঞ্চিত, তার কথা আমাদের আগে ভাবতে হবে। নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য আমাদের আগে কাজ করতে হবে। পঞ্চমত, আজকে মেয়েদের আসল কাজ কী তা নিয়ে কথা উঠছে। তারা কি ঘরে বসে থাকবে- এমন প্রশ্ন উঠছে। কোনো মেয়ে যদি তার স্বাধীন সিদ্ধান্তে ঘরে থাকতে চায়, তবে তার সেটা করার অধিকার আছে। পুরুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য। কিন্তু আল্লাহ কোথাও বলেননি, নারীদের ঘরে বসে থাকতে হবে, বাইরের কাজ নারীরা করতে পারবেন না, বরং আল্লাহ মূল দায়িত্ব নারী-পুরুষের একই দিয়েছেন। সূরা তাওবার ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- ‘নারী-পুরুষের দায়িত্ব ছয়টি : ১. তারা ভালো কাজের আদেশ দেবে। ২. মন্দ কাজের ব্যাপারে নিষেধ করবে। ৩. উভয়ে নামাজ কায়েম করবে। ৪. জাকাত দেবে। ৫. আল্লাহকে মানবে। ৬. রাসূল সা:কে মানবে। এসব কথার মাধ্যমে আল্লাহ নারীদের সব ভালো কাজে অংশগ্রহণকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এটাই ইসলামের নীতি। এ বিষয়ে আল্লাহ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যারা এ ছয়টি দায়িত্ব পালন করবে তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা রহমত বর্ষণ করবেন। কুরআনের বেশ কয়েকটি তাফসির পড়ে এবং পবিত্র কুরআন ও সুন্নতে রাসূলে পুরোপুরি বিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, এ ছয়টি দায়িত্বের মধ্যে নারী-পুরুষ সবাই সমান। রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদি সব কাজই এ ছয়টির আওতায় পড়ে। আয়াতটিতে আরো বলা হয়েছেÑ ‘মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক (ওয়ালি), একে অপরের বন্ধু, একে অপরের সাহায্যকারী।’ (সূরা আত তাওবা-৯:৭১) উল্লিখিত বিষয়ে আগে যেসব আয়াত আছে, সেগুলোকে এই আয়াতের আলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে। এই আয়াতে বলা আছে, নারী-পুরুষ একে অপরের অভিভাবক। অনেকে বলেন, নারী অভিভাবক হতে পারে না; কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, নারী অভিভাবক হতে পারে। কুরআনে এ ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই। পরীশেষে এই পর্বে এখনই সমাপ্ত করছি!!! আসা করি সকলেরই ভাল লেগেছে।
0 Comments